এক নজরে পশ্চিমবঙ্গের নদ নদী

নমস্কার বন্ধুরা, আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হল পশ্চিমবঙ্গের নদ নদী। এটি ভূগোলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষাগুলোতে এবং স্কুলের পরীক্ষাগুলোতেও এই অধ্যায়টি থেকে নানারকম প্রশ্ন এসে থাকে।
তাই আর দেরি না করে আলোচনা শুরু করা যাক।

উত্তরে চিরতুষারাবৃত হিমালয় পর্বতের অবস্থান, প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং অধিকাংশই স্বল্প উচ্চতা ও নিম্ন ভূমির কারণে পশ্চিমবঙ্গে অসংখ্য নদনদীর সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে পশ্চিমবঙ্গকে নদীমাতৃক রাজ্য বলা হয়।

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলায় অসংখ্য নদী সম্পৃক্ত হয়ে আছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ও জীবিকার সাথে। নদী ও জীবন এখানে অবিচ্ছেদ্য ও একাত্ম।

উৎপত্তি ও গতি প্রকৃতি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের নদীগুলিকে পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। যথা —
(ক) গঙ্গা ও তার শাখা নদী সমূহ
(খ) ভাগীরথী হুগলি নদীর পূর্ব
দিক দিয়ে প্রবাহিত নদী সমূহ

(গ) ভাগীরথী হুগলি নদীর পশ্চিম
দিক দিয়ে প্রবাহিত নদী সমূহ

(ঘ) উত্তরবঙ্গের নদী সমূহ
(ঙ) সুন্দরবনের নদী সমূহ

(ক) গঙ্গা ও তার শাখা নদী সমূহ
গঙ্গা ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের সর্ব প্রধান নদী। গাড়োয়াল হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন ভাগীরথী ও অলকানন্দ হিমবাহ থেকে উৎপন্ন অলকানন্দা দেব প্রয়াগের নিকট মিলিত হয়ে গঙ্গা নাম ধারণ করে প্রথমে উত্তর প্রদেশ এবং পরে বিহারের রাজমহল পাহাড় এর কাছে পশ্চিমবঙ্গের প্রবেশ করেছে।

মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানের কাছে গঙ্গা নদী ভাগীরথী ও পদ্মা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। প্রধান শাখা পদ্মা নামে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অপর শাখা ভাগীরথী-হুগলি নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে সাগর দ্বীপের নিকট বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

মুর্শিদাবাদ থেকে নবদ্বীপ শহর পর্যন্ত এই নদীর নাম ভাগীরথী এবং নবদ্বীপ থেকে মোহনা পর্যন্ত এই নদী হুগলি নদী নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী-হুগলি নদী গঙ্গা নামে পরিচিত।

গঙ্গা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৫১০ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গে দৈর্ঘ্য ৫২০ কিলোমিটার। গঙ্গার বাম তীরের উপনদী হল রামগঙ্গা, গোমতী, ঘর্ঘরা, গন্ডক ও কোশী। ডান দিলের উপনদী হল যমুনা ও শোন।

কলকাতা, হরিদ্বার, কানপুর, এলাহাবাদ, বারাণসী, পাটনা, ভাগলপুর গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ফারাক্কা ব্যারেজ গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত।

(খ) ভাগীরথী হুগলি নদীর পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত নদী সমূহ :- ভাগীরথী হুগলি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নদী। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত ভাগীরথী নদী ২২০ কিলোমিটার বিস্তৃত। নবদ্বীপ থেকে মোহনা পর্যন্ত হুগলি নদী ২৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত।

ভাগীরথী হুগলি নদীর পূর্ব দিকের নদীগুলি বৃষ্টির জলে পুষ্ট। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়ে এইসব নদীতে জলপ্রবাহ থাকে না বললেই চলে। আবার বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির ফলে প্রায়শই বন্যা দেখা দেয়। ভাগীরথী হুগলি নদীর পূর্ব দিকের নদী গুলির মধ্যে জলঙ্গি, ভৈরবী, ইছামতি, মাথাভাঙ্গা, চূর্ণী বিদ্যাধরী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই নদী গুলির বেশিরভাগই পদ্মার শাখা নদী।

জলঙ্গি নদী :- জলঙ্গী নদী পদ্মা নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নদীটি মায়াপুরের কাছে ভাগীরথী বা গঙ্গা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার। ভৈরব নদী এই জলঙ্গী নদীর সাথে মিশেছে।

মাথাভাঙ্গা নদী :- মাথাভাঙ্গা নদীটির উৎপত্তি পদ্মা থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে। নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। একটি শাখা নদীয়ার মাজদিয়ায় প্রবেশ করে চূর্ণী ও ইছামতি নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। চূর্ণী নদী নদিয়া জেলাতে প্রবাহিত হয়ে ভাগীরথীতে পতিত হয়েছে। অন্যদিকে ইছামতি নদীটি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মাথাভাঙ্গা নদীর দৈর্ঘ্য ১২১ কিলোমিটার ও ইছামতি নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৩৪ কিলোমিটার।

ভৈরব নদী:- ভৈরব নদীটির উৎপত্তিস্থল আখিরিগঞ্জ। নদীটি মুর্শিদাবাদ জেলা পেরিয়ে নদীয়া জেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

বিদ্যাধরী নদী :- বিদ্যাধরী নদীটি নদীয়া জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাতলা নদীতে মিশেছে। বিদ্যাধরী নদীর একটি শাখা নদী হল পিয়ালী।

(গ) ভাগীরথী হুগলি নদীর পশ্চিম দিকে প্রবাহিত নদীসমূহ বা বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী সমূহ বা পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী সমূহ :- পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদী বা ভাগীরথী হুগলি নদীর পশ্চিম দিকে প্রবাহিত নদীগুলি সব বৃষ্টির জলে পুষ্ট। এদের বেশিরভাগ নদীর উৎপত্তিস্থল ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল। বৃষ্টির জলে সৃষ্ট নদী গুলির মধ্যে দামোদর, কংসাবতী বা কাসাই, শিলাবতী বা শিলাই, অজয়, রূপনারায়ণ, ময়ূরাক্ষী, সুবর্ণরেখা, কেলেঘাই হলদি উল্লেখযোগ্য।

দামোদর নদ :- এটি পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘতম নদী। ছোটনাগপুর মালভূমির খামারপাত থেকে উৎপন্ন হয়েছে। গঙ্গার শাখা হুগলির উপনদী হল দামোদর।

এর মোট দৈর্ঘ্য ৫৯২ কিলোমিটার। এই নদী দেওনদী নামে ও পরিচিত। প্রতি বর্ষায় দামোদরের বন্যায় অনেক প্রাণ ও সম্পত্তি হানির কারণে দামোদর নদ “বাংলার দুঃখ” হিসেবে পরিচিত। দামোদর পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। দামোদর নদ উলুবেড়িয়ার নিকট ভাগীরথী হুগলি নদীতে মিশেছে।

আয়র, বোকারো, কোনার, বরাকর ও উশ্রী প্রভৃতি হল দামোদরের প্রধান উপনদী। মুন্ডেশ্বরী, কৌশিকী হল দামোদরের শাখা নদী। বরাকর হল দামোদরের প্রধান উপনদী।

বাঁশলাই নদী :- বাসলাই নদী ভাগীরথী নদীর উপনদী এটি ঝাড়খণ্ডের রাজমহল এলাকার বাঁশপাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভাগীরথী নদীতে মিশেছে।এই নদীর দৈর্ঘ্য ১২২ কিমি।
ভোরসা, কারজোর, সুখরা, ইকরি প্রভৃতি বাঁশলাই নদীর উপনদী।

দ্বারকা নদ :- দ্বারকা নদ ভাগীরথীর একটি উপনদী। দ্বারকা নদের উৎপত্তি ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা বিভাগে। এই নদ মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদীতে মিলিত হয়েছে। দ্বারকা নদীর তীরে অবস্থিত তারাপীঠ মন্দির।
বামিনী, কুলিয়া, ঘাড়মোড়া, চিলা ইত্যাদি দ্বারকা নাদের উপনদী।

ব্রাহ্মণী নদী :- ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা জেলার দুধুয়া পাহাড় থেকে উৎপন্ন। এটি গঙ্গার ডান তীরের উপনদী। এর অপর নাম কালিন্দী। মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমার সাঁকোঘাট গ্রামের কাছে ব্রাহ্মণী নদী দ্বারকা নদে মিশেছে। কান্দি মহকুমায় ব্রাহ্মণী নদী ভাগীরথীর সাথে মিলিত হয়েছে।

ব্রাহ্মণীর প্রধান দুটি উপনদী ত্রিপিতা ও গামারী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুরনো রেশম কুঠি ও মহারাজা নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির এই নদীর তীরে অবস্থিত।

হলদি নদী :- কংসাবতী ও কেলেঘাই নদীর যুগ্ম প্রবাহের নাম হলদি। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। হলদি নদী হুগলি নদীতে মিশেছে। হলদি নদীর মোহনার কাছেই নতুন বন্দর নগরী হলদিয়া ও হলদিয়া বন্দর গড়ে উঠেছে।

ময়ূরাক্ষী নদী :- ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথ ধামের ত্রিকুট পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। নদীটি মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুগলি নদীতে মিশেছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার।

পুস্কানি, ব্রাহ্মণী, বক্রেশ্বর, কোপাই দ্বারকা প্রভৃতি এই নদীর উপনদী। ময়ূরাক্ষী নদীর গতিপথে দুটি বাঁধ বা ড্যাম আছে। একটি হল ম্যাসানঞ্জোর ড্যাম যেটি কানাড়া বাঁধ নামেও পরিচিত। অপরটি হল তিলপাড়া ড্যাম।

অজয় নদী :- ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে বীরভূম ও বর্ধমান জেলার সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাটোয়ার নিকট ভাগীরথীতে পড়েছে। অজয় গঙ্গার প্রধান শাখা ভাগীরথী হুগলির উপনদী। অজয় নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৭৬ কিলোমিটার।

অজয় নদীর উপনদী গুলি হল– পাথরো, জয়ন্তী, তুমিনি ও কুনুর।

দ্বারকেশ্বর নদ :- পুরুলিয়া জেলার হুড়া গ্রামের মাঝে অবস্থিত একটি বড় ঝিল থেকে দ্বারকেশ্বর নদের উৎপত্তি। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের কাছে শিলাবতী নদীর সাথে মিশেছে। বাঁকুড়া জেলার ছাতনার কাছে কুমাসি ও বাঁকুড়া শহরের কাছে গন্ধেশ্বরী নদী দ্বারকেশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

বিড়াই, আড়কুসো, হোরিংপুর প্রভৃতি হল দ্বারকেশ্বরের উপনদী। বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর ও আরামবাগ এই তিনটি শহর এই নদীর তীরে অবস্থিত।

শিলাবতী বা শিলাই নদী :- পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা শহরের কাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে বাঁকুড়ায় প্রবেশ করেছে। পরে সিমলিপাল হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রবেশ করে ঘাটালের কাছে শিলাবতী দ্বারকেশ্বরে পড়েছে।

জয়পান্ডা, পুরন্দর, কুলবাই, তমাল ও পারাং হল শিলাবতী বা শিলাই নদীর উপনদী। ঘাটাল এই নদীর তীরে অবস্থিত একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র।

রূপনারায়ণ নদী :- শিলাবতী ও দ্বারকেশ্বরের মিলিত প্রবাহের নাম রূপনারায়ণ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালে শিলাবতী ও দ্বারকেশ্বর মিলিত হয়েছে। রূপনারায়ণ দামোদর নদ বা মুন্ডেশ্বরী নদীর সাথে মিলিত হয়ে হুগলি নদীতে মিশেছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার।

রূপনারায়ণ নদীর তীরে অবস্থিত কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গাদিয়াড়ারা এই নদীর তীরের মূল পর্যটন কেন্দ্র। এছাড়া রূপনারায়ণ নদীর তীরে অবস্থিত কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কুঠি দেউলটি।

কংসাবতী নদী :- কংসাবতীকে স্থানীয় ভাষায় কাঁসাই বলে। পুরুলিয়া জেলার ঝালদা পাহাড় থেকে কংসাবতী নদীর উৎপত্তি। কেশপুরের কাছে কংসাবতী দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি শাখা রূপনারায়ণ এর সাথে মিশেছে, অন্যটি কেলেঘাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। বাঁকুড়া জেলায় কংসাবতী কুমারী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীর গতিপথ ৪৬৫ কিলোমিটার।

সাহারাঝোরা, বান্দু, কুমারী নদী ও ভৈরববাঁকী এগুলি কংসাবতী নদীর উপনদী। মুকুটমণিপুরে কংসাবতী ও কুমারী নদীর মিলনস্থলে বিখ্যাত কংসাবতী বাঁধ ও জলাধারটি গড়ে উঠেছে। মেদিনীপুর শহর এই কংসাবতীর তীরেই অবস্থিত।

সুবর্ণরেখা নদী :- সুবর্ণরেখা নদী রাঁচীর কাছে হুড্রু জলপ্রপাত থেকে উৎপন্ন হয়ে ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উড়িষ্যার তালসারির কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এই নদীর মোর দৈর্ঘ্য ৩৯৫ কিলোমিটার।

করকরি, জুমার, ডুলং, কাঞ্চি, রারু, খারকাই এগুলি হল সুবর্ণরেখা নদীর উপনদী। এই নদী তীরের বালুচরে অনেক সময় স্বর্ণ রেনু পাওয়া যেত বলে নদীটিকে সুবর্ণরেখা বলা হয়। এটি রাঁচি তথা ঝাড়খণ্ডের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ঘাটশিলা অবস্থিত যা একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থান।

(ঘ) উত্তরবঙ্গের নদী সমূহ :- পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলা গুলিকে একসাথে উত্তরবঙ্গ বলা হয়। এই অঞ্চলের নদীগুলির বেশিরভাগই হিমালয় পর্বতের পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নদীগুলি বরফ গলা জলে পুষ্ট। উত্তরবঙ্গের নদীগুলোতে সারা বছরই জল থাকে। এই অঞ্চলের নদীগুলি খরস্রোতা হওয়ায় এরা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশেষ উপযোগী। তিস্তা, করতোয়া, জলঢাকা, মহানন্দা, বালাসন, তোর্সা, সংকোশ, রায়ডাক, কালজানি, আত্রাই, পুনর্ভবা টাঙ্গন প্রভৃতি নদীগুলি হল এই অঞ্চলের প্রধান নদী।

তিস্তা নদী :- তিস্তা নদী বাংলাদেশ ভারতের একটি আন্ত:সীমান্ত নদী এবং সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের প্রধান নদী। এটি আবার উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম ও সর্ব প্রধান নদী। তিস্তা নদীকে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জীবনরেখা বলা হয়। তিস্তা নদী প্রকৃতপক্ষে তিব্বতের লাচেন এবং সিকিমের লাচুং নদীর মিলিত প্রবাহ। তিস্তা নদীর উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত সো লামো হ্রদে। এই নদী সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে। তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার, তার মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত।

তিস্তা নদী ছাঙ্গু ইয়ংথাম ও ডং কিয়ালা পর্বত শ্রেণী থেকে উৎপন্ন ছোট ছোট নদীর জলে পুষ্ট। রংপো, রিয়াং, লাচুং, রানীখোলা, রেলি নদী, তালং, ল্যাংচু, রঙ্গীত এগুলি সব তিস্তা নদীর উপনদী। রঙ্গিত তিস্তার প্রধান উপনদী। খাগট, বুড়ি তিস্তা তিস্তার শাখা নদী।

তিস্তা কথাটি “ত্রিস্রোতা” থেকে এসেছে। কারণ তিস্তা অতীতে তিনটি শ্রোত ধারায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতো। এই তিনটি ধারা হল করতোয়া, আত্রাই এবং পুনর্ভবা। সিংতম, রংপো, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি মেখলিগঞ্জ প্রভৃতি শহর তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদী ত্রাসের নদী নামে পরিচিত।

করতোয়া নদী :- রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অন্তর্গত একটি বড় ও পবিত্র নদী হল করতোয়া নদী। এটি ভারত বাংলাদেশের একটি আন্ত:সীমান্ত নদী। করতোয়া নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলায় উৎপত্তি লাভ করেছে। পরবর্তীকালে এই নদীর জলধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং দিনাজপুর সদর উপজেলার সরকারপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আত্রাই নদীতে পতিত হয়েছে। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১৮৭ কিলোমিটার।

করতোয়া একসময় তিস্তা নদীর প্রধান ধারা ছিল। বন্যার ফলে করতোয়ার সঙ্গে তিস্তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ধীরে ধীরে করতোয়া পাঁচটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উত্তরের অংশের নাম দিনাজপুর-করতোয়া, পূর্বে রংপুর-করতোয়া, বগুড়া-করতোয়া পাবনা-করতোয়া ও আত্রাই-গুড়। এই পাঁচটি করতোয়া ছাড়া উত্তরবঙ্গের ছোট ছোট নদী ও করতোয়া নামে পরিচিত। এই নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৯৭ কিলোমিটার।

মহাস্থানগড়, বগুড়া এই করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত।

তোর্সা নদী :- তোর্সা পূর্ব তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা থেকে উৎপন্ন হয়ে ভুটানে প্রবেশ করেছে। চুম্বি উপত্যকা ও ভুটানে তোর্সা “আমো-ছু” নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা ও বাংলাদেশে এই নদী তোর্সা নামে পরিচিত।
তোর্সা নদী ভুটান অতিক্রম করে জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর তোর্সা নদী কোচবিহার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ধুবড়ির কাছে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে।

নদীটির আনুমানিক দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। তোর্সার প্রধান উপনদী হল — হলং, নলঙ্গী, সুনজাই, কালা তোর্সা। তোর্সার শাখা নদীগুলি হল চর তোর্সা, শিলি তোর্সা, বুড়ো তোর্সা ও ধরলা। কোচবিহার, ফুন্টসলিং ও জয়গাঁও শহর এই নদীর তীরে অবস্থিত।

জলঢাকা :- সিকিমের বিদাং হ্রদ থেকে জলঢাকা নদীর উৎপত্তি। দি-চু ও লি-চু নদীর মিলিত প্রবাহের নাম জলঢাকা। জলঢাকা ভুটান দার্জিলিং সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রবেশের পর ধরলা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ধরলা নামেই বুড়িগ্রামের কাছে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে।

জল ঢাকার মোট দৈর্ঘ্য ২৩৬ কিলোমিটার। জলঢাকার উল্লেখযোগ্য উপনদী গুলি হল মূর্তি, ডায়না, দুধুয়া, সুনজাই। কোচবিহার জেলায় জলঢাকার উল্লেখযোগ্য উপনদী গুলি হল ধরলা, গিধারি , ডোলং। গরুমারা অভয়ারণ্য এই নদীর তীরে অবস্থিত।

কালজানি :- ভুটান পাহাড় থেকে নির্গত আলাইকুড়ি এবং বক্সাদুয়ারের কাছে উৎপন্ন ডিমা নদী আলিপুরদুয়ারের উত্তরে মিলিত হয়ে কালজানি নাম নিয়ে কোচবিহার জেলায় প্রবেশ করেছে। তোর্সার সাথে মিলিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রে পড়েছে।

কালজানির প্রধান উপনদী হল — গদাধর, টেকো ও নেনাই। আলিপুরদুয়ার শহর কালজানি নদীর তীরে অবস্থিত।

রায়ডাক :- রায়ডাক নদী ভুটানে যার নাম “ওয়াং ছু বা ওং ছু”। রায়ডাক ব্রহ্মপুত্রের উপনদী। এই নদী ভারত, ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। তিব্বত-ভুটান সীমান্তে চোমোলহরী পর্বতশৃঙ্গের হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভুটানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবেশ করেছে।

পরবর্তীকালে রায়ডাক পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার ডুয়ার্সে প্রবেশ করে কোচবিহার জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় রায়ডাক ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। এই অঞ্চলে রায়ডাক নদী দুধ কুমার নদী নামে পরিচিত ।

ভুটানে রায়ডাক নদী ও তার শাখা নদী গুলির মোট দৈর্ঘ্য ৬১০ কিলোমিটার। রায়ডাক নদীর গতিপথের একক দৈর্ঘ্য ৩৭০ কিলোমিটার। রায়ডাক আন্তর্জাতিক নদী। রায়ডাক নদীর তীরে অবস্থিত থিম্পু নগর। দীপা রায়ডাক নদীর উপনদী। চুখা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রায়ডাক নদীর উপর বাঁধ তৈরি করে নির্মাণ করা হয়েছে।

সংকোশ নদী :- সংকোশ নদী গদাধর নদী নামেও পরিচিত। ভুটানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে পুনাখা পর্বতমালার গাংছেনটা পর্বত শৃঙ্গ থেকে উৎপত্তি লাভ করে জলপাইগুড়ি জেলার কালি খোলার নিকট পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। এরপর সংকোশ নদী পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে কোচবিহার জেলায় প্রবেশ করেছে। আসামে সংকোশ নদী ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে। কোচবিহারের ভেঁইসকুচির কাছে সংকোশ নদী রায়ডাকের সঙ্গে মিলিত হয়। এদের সম্মিলিত ধারার নাম গদাধর বা বড় গদাধর। পরে এই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

সংকোশ মো চু এবং সবর্নকোশ নামে ও পরিচিত। সংকোশ নদীর বৃহত্তম উপনদী হল মো চু এবং ফো চু। ভুটানের ওয়াংডু ফোড্রয়ং শহর এই সংকোশ নদীর তীরে অবস্থিত ।

মহানন্দা :- দার্জিলিং হিমালয়ের পশ্চিমাংশ দিয়ে যে মহানদী প্রবাহিত হয়েছে তা সমভূমি প্রবাহে মহানন্দা নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে প্রবাহের দৈর্ঘ্য অনুসারে এটাই উত্তরবঙ্গের দীর্ঘতম নদী। দার্জিলিং জেলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

পরে আবার এই নদী উত্তর দিনাজপুর জেলায় প্রবেশ করে, মালদা হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর অংশটির দৈর্ঘ্য ৩৬ কিলোমিটার। মহানন্দা নদী বাংলাদেশ গঙ্গার একমাত্র উপনদী।

মহানন্দা নদী ভারত বাংলাদেশের একটি আন্ত:সীমান্ত নদী। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ৩৬০ কিলোমিটার। মহানন্দার পশ্চিম তীরের প্রধান উপনদী হল কালিন্দী। পূর্ব তীরের প্রধান উপনদী গুলি হল নাগর, টাঙ্গন, পুনর্ভবা প্রভৃতি। মহানন্দার গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপনদী হলো কুলিক, গামার, বালাসন, মেচী। শিলিগুড়ি , ইংরেজবাজার ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ এই নদীর তীরে অবস্থিত। মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিমালয়ের পাদদেশে তিস্তা এবং মহানন্দা নদীর মাঝে অবস্থিত ।

বালাসন নদী :- উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং জেলার গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলির একটি হল বালাসন। দার্জিলিং জেলা সদর থেকে ১৮ কিমি উত্তরে সুকিয়া জোড়পোখরি অঞ্চল থেকে সৃষ্ট হয়ে উত্তরবঙ্গ সমভূমিতে শিলিগুড়ি শহরের দক্ষিণ প্রান্তে মহানন্দা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

জোড়পোখরি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যটি এই নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত। রঙ, রিং এই নদীর উপনদী।

(ঙ)সুন্দর বনের নদী সমূহ বা জোয়ারের জলে পুষ্ট নদী সমূহ বা ব-দ্বীপ অঞ্চলের নদী সমূহ :- পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিনাংশে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রবাহিত নদীগুলিকে জোয়ারের জলে পুষ্ট নদী বলা হয়। এই অংশে যেসব নদী প্রবাহিত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই ব-দ্বীপ গঠন করেছে। এই অঞ্চলের নদীকে সক্রিয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের নদ নদীও বলা হয়। এখানকার নদীগুলি বর্তমানে উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমুদ্রের জলবাহী খাঁড়িতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের জোয়ারের জলে পুষ্ট নদী গুলির মধ্যে পিয়ালী, মাতলা, সপ্তমুখী, ঠাকুরন, রায়মঙ্গল, গোসাবা বিদ্যাধরী, হাড়িয়াভাঙ্গা, কালিন্দী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

সপ্তমুখী

উৎস :- সুলতানপুর (দক্ষিণ ২৪ পরগনা)
মোহনা :- বঙ্গোপসাগর
অবস্থান :- সুন্দরবন
প্রবাহ পথের মোট দৈর্ঘ্য :- ৮০ কিলোমিটার
প্রবাহপথে নদীটি মুড়িগঙ্গা নদী ও দেওগ্রা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

পিয়ালী

উৎস :- বিদ্যাধরী নদী
মোহনা :- মাতলা নদী
অবস্থান :- সুন্দরবন

মাতলা নদী

উৎস :- হুগলি নদী
মোহনা :- বিদ্যাধরী নদী
অবস্থান :- ক্যানিং, সুন্দরবন
মাতলা নদীর উপর ২১১৩ ফুট দীর্ঘ সেতুটি ক্যানিং ও বাসন্তীকে যুক্ত করেছে।

ঠাকুরন নদ

উৎস :- দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জয়নগর
মোহনা :- বঙ্গোপসাগর
অবস্থান :- সুন্দরবন
ঠাকুরন নদীর দুই তীরে অবস্থিত বনাঞ্চল আইনের আওতায় সংরক্ষিত। এগুলি লবণাম্বু জাতীয় উদ্ভিদ।

গোসাবা নদী

উৎস :- মাতলা নদী ও রায়মঙ্গল নদী
মোহনা :- বঙ্গোপসাগর
অবস্থান :- সুন্দরবন
মাতলা ও রায়মঙ্গল নদীর মিলিত প্রবাহ গোসাবা নদী নামে পরিচিত।

মুড়িগঙ্গা নদী

উৎস :- হুগলি নদী
মোহনা :- বঙ্গোপসাগর
অবস্থান :- সুন্দরবন (সাগরদ্বীপ)

বিদ্যাধরী নদী

উৎস :- নদীয়া জেলার হরিণঘাটা
মোহনা :- রায়মঙ্গল নদী
অবস্থান :- সুন্দরবন
চন্দ্রকেতুগর নদী বন্দরটি এই নদীর তীরে অবস্থিত।

রায়মঙ্গল নদী

উৎস :- ইছামতী নদী
মোহনা :- বঙ্গোপসাগর
অবস্থান :- সুন্দরবন
দৈর্ঘ্য :- ৬২ কিলোমিটার
বাংলাদেশ ভারতের আন্ত সীমান্ত নদী হল রায়মঙ্গল নদী। নদীটি উপকূলীয় জোয়ার ভাঁটার নদী।

কালিন্দী নদী

উৎস :- ইছামতি নদী
মোহনা :- রায়মঙ্গল নদী
অবস্থান :- সুন্দরবন
দৈর্ঘ্য :- ৫৫ কিলোমিটার

Sharing Is Caring:

Leave a Comment