(৩) গঙ্গার ব-দ্বীপ সহ সমভূমি অঞ্চল
অবস্থান :- উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল বাদে পশ্চিমবঙ্গের বাকি অংশ সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত। উত্তরের শিলিগুড়ি মহকুমা থেকে দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত সমগ্র অংশই এই সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত।
এই সমগ্র সমভূমি অঞ্চলটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (ক) উত্তরবঙ্গের সমভূমি (খ)দক্ষিণ বঙ্গের সমভূমি
(ক) উত্তরবঙ্গের সমভূমি :- উত্তরে শিলিগুড়ি মহকুমা থেকে দক্ষিনে মালদা জেলার দক্ষিণ সীমা বা গঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। সমগ্র উত্তরবঙ্গ সমভূমি দুটি অংশে বিভক্ত i) তরাই ও ডুয়ার্স সমভূমি ও ii) উত্তরবঙ্গ বা উত্তরের সমভূমি।
i) তারাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল বা সমভূমি :- দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা ও জলপাইগুড়ি জেলার অধিকাংশ এলাকা নিয়ে এই সমভূমিটি গঠিত।
তিস্তা নদীর পশ্চিমের অংশ তরাই সমভূমি নামে পরিচিত। দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা ও জলপাইগুড়ি জেলার প্রায় সমস্ত অংশ এবং কোচবিহার জেলার উত্তরাংশ তরাই অঞ্চলের অন্তর্গত। ফরাসি শব্দ তরাই কথার অর্থ স্যাঁতস্যাঁতে নিম্নভূমি।
তিস্তা নদীর পূর্বাংশ ডুয়ার্স নামে পরিচিত। পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশের পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং অসমের ধুবড়ি,কোকড়াঝাড়, বরপেটা, গোয়ালাপাড়া ও বঙ্গাইগাঁও জেলা নিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চল গঠিত। ডুয়ার্স শব্দের অর্থ দুয়ার বা দরজা। এই সমভূমি দিয়ে ভুটানে যাওয়ার অনেকগুলি রাস্তা আছে বলেই এই সমভূমিটি ডুয়ার্স নামে পরিচিত।
ডুয়ার্স কে আবার অবস্থান অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা i)পশ্চিমে শিলিগুড়ি ডুয়ার্স ii) পূর্বে আলিপুর ডুয়ার্স iii) জলপাইগুড়ি ডুয়ার্স
নদনদী :- তারাই অঞ্চলের উপর দিয়ে মেচি, বালাসন, মহানন্দা, তিস্তা লিস, ঘিস, মূর্তি, জলঢাকা, মজনু, তোর্সা, ডায়না, গদাধর, কালজানি, রায়ডাক প্রভৃতি নদী প্রবাহিত।
ii) উত্তরের সমভূমি বা উত্তরবঙ্গ সমভূমি :- উত্তরে তরাই সমভূমির দক্ষিণাংশ থেকে শুরু করে দক্ষিণে গঙ্গা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত সমভূমিটি উত্তরবঙ্গ সমভূমি নামে পরিচিত।
জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার দক্ষিণাংশ এবং সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদা জেলা নিয়ে এই সমভূমিটি গঠিত।
ভূপ্রকৃতির তারতম্য অনুসারে এখানে বিক্ষিপ্তভাবে তিন প্রকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ দেখা যায়। এগুলি হলো–
তাল :- কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাংশে এবং মালদা জেলার পশ্চিমাংশে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা নিমভূমি বা জলাভূমি স্থানীয় ভাষায় তাল নামে পরিচিত।
বরেন্দ্রভূমি :- প্রাচীন পলিমাটি সমৃদ্ধ উঁচু ভূমিভাগ দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদা জেলার পূর্বাংশ বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত।
দিয়ারা :- মালদা জেলার কালিন্দী নদীর দক্ষিণে অবস্থিত উর্বর ভূমি ভাগ দিয়ারা নামে পরিচিত।
নদ-নদী :- উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের প্রধান নদী হল মহানন্দা।
(খ) দক্ষিণবঙ্গের সমভূমি :- এই সমভূমি অঞ্চল কে ৪টি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। —
i) রাঢ় সমভূমি
অবস্থান :- ভাগীরথী হুগলি নদীর পশ্চিমাংশের নবীন পলি অঞ্চল বাদে বীরভূম,বাঁকুড়ার প্রায় সমগ্র অংশ ও মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর এবং বর্ধমান জেলা নিয়ে গঠিত রাঢ় সমভূমি অঞ্চলটি।
পুরনো পলিমাটি দ্বারা গঠিত এই অঞ্চলে ল্যাটেরাইট জাতীয় লাল মাটি দেখা যায়। সাঁওতালি ভাষায় রাঢ় শব্দের অর্থ পাথুরে জমি। পশ্চিমের ছোটনাগপুর মালভূমির ক্ষয়জাত পদার্থ নদী দ্বারা বাহিত হয়ে এই অঞ্চলে সঞ্চিত হয়ে রাঢ় সমভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
নদনদী :- ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর দ্বারকেশ্বর, শিলাই ও কাঁসাই এই অঞ্চলের প্রধান নদী। নদী গুলি ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। ভাগীরথী এই অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুগলি নদীতে মিশেছে। অন্যদিকে সুবর্ণরেখা নদীর কিছুটা অংশ এই অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
ii) উপকূলের বালুকাময় সমভূমি :- মেদিনীপুর জেলার উপকূল ভাগ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। বঙ্গোপসাগর উপকূল বরাবর এই সমভূমিটি অবস্থিত। বালি দারা গঠিত এই অঞ্চলটি প্রায় সমতল হলেও মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বালির ঢিবি দেখা যায়। সর্ব দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের তীরে দীঘা সমুদ্র সৈকত অবস্থিত। এই অঞ্চলের দুটি প্রধান বালিয়াড়ি হল কাঁথি বালিয়াড়ি ও দীঘা বালিয়াড়ি।
iii) গঙ্গার ব-দ্বীপ অঞ্চল
অবস্থান :- মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্বাংশ, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা, সুন্দরবন বাদে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা, বর্ধমান এবং দীঘা বাদে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা নিয়ে এই বদ্বীপ অঞ্চল গঠিত। সমভূমিটি উত্তর থেকে দক্ষিনে ক্রমশ ঢালু। গঠন ও উৎপত্তি অনুসারে এই ব-দ্বীপ সমভূমিটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা —
মৃতপ্রায় বা মুমূর্ষু বদ্বীপ :- এই অঞ্চলটি গঠিত মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলা নিয়ে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ নদীগুলি মজে যাওয়ার ফলে বদ্বীপ তৈরি সম্ভব নয়, তাই এই সমভূমিকে মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ সমভূমি বলে।
পরিণত ব-দ্বীপ :- বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলি জেলার সমভূমি নিয়ে এই ব-দ্বীপ অঞ্চলটি গঠিত। ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে প্রচুর বালি, কাঁকর, পলি প্রভৃতি জমে এই অঞ্চলে ব-দ্বীপ গঠনের কাজ প্রায় শেষ। এখানে জলাভূমির সংখ্যাও কম।
সক্রিয় ব-দ্বীপ :- উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কলকাতা জেলার দক্ষিণে অবস্থিত সুন্দরবন অঞ্চলটি নিয়ে এই ব-দ্বীপ সমভূমি অঞ্চলটি গঠিত। এই অঞ্চলের নদীগুলি পর্যাপ্ত পরিমাণে পলি সঞ্চয় করে ব-দ্বীপ গঠনের কাজ এখনো করে চলেছে। তাই এটি সক্রিয় ব-দ্বীপ অঞ্চল নামে পরিচিত।
নদনদী :- এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য প্রধান নদী গুলি হল গঙ্গা, পদ্মা, ভাগীরথী এবং তাদের অসংখ্য শাখানদী ও উপনদী।
iv) সুন্দরবন অঞ্চল :- দক্ষিণ ২৪ পরগনার দক্ষিণাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ, নামখানা, মথুরাপুর, জয়নগর, কুলতলী, ক্যানিং, বাসন্তী, হাড়োয়া, মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ ১৫ টি থানা নিয়ে বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চল গঠিত। সমুদ্র গর্ভে ক্রমাগত পলি অঞ্চলের ফলে নতুন নতুন দ্বীপের উৎপত্তি ঘটেছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পূর্বাশা দ্বীপ, সাগরদ্বীপ, কলসদ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জ, হলিডে, লোথিয়াম, বালুচরি, ডালহৌসি প্রভৃতি এখানকার উল্লেখযোগ্য দ্বীপ। সাগরদ্বীপ হলো সবচেয়ে বড় দ্বীপ।
এই অঞ্চলটি পুরোপুরি ভাবে সক্রিয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্গত। সুন্দরী গাছের প্রাধান্যের জন্য এই অঞ্চলের নাম হয়েছে সুন্দরবন।