হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কারণ
হরপ্পা সভ্যতা ছিল এক বিশাল প্রাণবন্ত সভ্যতা এবং এই প্রাণবন্ত সভ্যতা কি কারণে বিলুপ্ত হয়েছিল, তা সঠিক ভাবে জানা যায় না।এই সভ্যতার ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ বিভিন্ন মত প্রকাশ প্রকাশ করেছেন ।কোন একটি বিশেষ কারণে এই প্রাণবন্ত সভ্যতার পতন ঘটেছিল তা বলা যায় না। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।এই অবলুপ্তির প্রকৃত কারণ নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই সভ্যতার পতনের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের ওপর জোর দিয়েছেন।সেগুলি হল…..
জলবায়ুর পরিবর্তন :- অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন পূর্বে সিন্ধু উপত্যকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো এবং এই বৃষ্টিপাতের ফলে সিন্ধু উপত্যকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। কিন্তু কালক্রমে এই অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়। স্যার মার্টিমার হুইলারের মতে, এই অঞ্চলে পোড়া ইঁটের প্রচুর ব্যবহারের কারণে ব্যাপকভাবে বৃক্ষছেদন শুরু হয় এবং অঞ্চলটি বনশূন্য হয়ে পড়ে, ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে এবং অঞ্চলটি মরুভূমিতে পরিণত হয়। যার কারণে এই অঞ্চলটি জনশূন্য হতে থাকে।
বন্যা:- ড: এম. আর. সাহানীর মতে, সিন্ধু নদীর বন্যার ফলে সভ্যতাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাঁর মতে, ‘প্লাবন সিন্ধু সংস্কৃতিকে ভাসিয়ে দেয়।’
ভূমিকম্প :- এই সভ্যতাটি ধ্বংসের জন্য অনেকে ভূমিকম্প কেও কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। মহেঞ্জোদারোতে খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত ক্ষতবিক্ষত নরকঙ্কাল গুলি দেখে মনে করা হয় যে, ভূমিকম্পের কারণে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ায় তাদের শরীরে ক্ষত চিহ্ন গুলি হয়েছিল।
সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন :- অনেক ঐতিহাসিক এর মত অনুযায়ী শতদ্রু,যমুনা ও সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এই সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য মহেঞ্জোদারো বন্দর হিসেবে তার গুরুত্ব হারায়। জলের অভাবে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আর যেহেতু সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি, তাই কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ফলে জনবাসীরা ওই স্থান ত্যাগ করতে থাকে।
খরা :- অনেক ঐতিহাসিক এর মতে পোড়া ইটের প্রচুর ব্যবহারের জন্য অঞ্চলটিতে ব্যাপকভাবে বৃক্ষ ছেদন শুরু হয়, যার ফলে জঙ্গলের পরিমাণ কমতে থাকে, সাথে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও হ্রাস পেতে থাকে। এইভাবে এক সময় টানা অনাবৃষ্টির ফলে খরা দেখা দেয় যার ফলে কৃষিকাজ বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
নাগরিক আদর্শের অবনতি :- হরপ্পা সভ্যতা পতনের জন্য অনেকেই নাগরিক আদর্শের অবনতির কথা বলেছেন। মহেঞ্জোদারোর নীচের স্তরে নগর পরিকল্পনা ও রক্ষনাবেক্ষন যত সুন্দর, পরের স্তরগুলোতে তা দেখা যায় না। দেখা যায় পরের স্তরে রাস্তা দখল করে বাড়ি তৈরী হচ্ছে, নর্দমা বুজে যাচ্ছে, গলিপথ ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এইভাবে হরপ্পা সভ্যতা ক্রমে ক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
বিদেশি আক্রমণ :- সিন্ধু উপত্যকায় খনন কার্যের ফলে রাস্তার ধারে, কুঁয়োর ধারে, বাড়ির মধ্যে, সিঁড়ির কাছে প্রভৃতি স্থানে ইতস্তত ছড়ানো কঙ্কালের স্তুপ পাওয়া গেছে। এই কঙ্কালগুলো প্রকাশ্য স্থানে পড়ে আছে, কোন সৎকার হয়নি এবং তাদের মাথার পিছনে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। বলা হয় যে বিদেশিদের অতর্কিত আক্রমণের ফলেই এই অবস্থা হয়েছে। পন্ডিতদের মতে হরপ্পা সভ্যতা যখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল তখন বৈদেশিক আক্রমণ এই সভ্যতার পতনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। বলাবাহুল্য সিন্ধু সভ্যতার পতনের কাল এবং আর্যদের আগমনের সময়কাল অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। তাই আর্যদেরই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসকারী বলে অনেকে মনে করেন। ঋকবেদে বৈদিক দেবতা ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ বা ‘নগরের ধ্বংসকারী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে আর্যদের ভারতে আগমনের সময়ে হরপ্পা ছাড়া আর কোন নগর সভ্যতা ছিল না। তাই আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস করেছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
রক্ষণশীল মানসিকতা :- হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের পেছনে রক্ষণশীল মানসিকতা কেও অনেকে দায়ী করেন। বলা হয়, হরপ্পা সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছালেও এই সভ্যতার অধিবাসীরা তাদের রক্ষণশীল মানসিকতা ত্যাগ করতে পারেনি বা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। কৃষি কাজে উন্নত পদ্ধতি বা যন্ত্রপাতির ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করেনি, কৃষির সম্প্রসারণের কথাও ভাবিনি। জলসেচের জন্য খাল খনন বা নিজেদের রক্ষা করার জন্য উন্নত অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করার ভাবনা ও তাদের ছিল না। এমনকি বৈদেশিক বাণিজ্য কমতে থাকলেও বিকল্প পথ তারা খোঁজার চেষ্টা করেনি। মূলত মিশরীয় বা সুমেরীয় সভ্যতা থেকে কোন শিক্ষা লাভ করেনি,তাদের এই রক্ষণশীল মানসিকতার জন্য।
বলা বা হল সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কোনো কারণই ত্রুটিমুক্ত নয়। আর কোন একটি নির্দিষ্ট কারণেও এই সভ্যতার ধ্বংস হয়নি।
উত্থান ও পতন দুটোই পরিপূরক শব্দ। ইতিহাস বা কালের নিয়ম অনুযায়ী উত্থান থাকলে তার পতনও একদিন নিশ্চিত হবেই।
সেটাই হয়েছিল হরপ্পা সভ্যতার সাথে।