নমস্কার বন্ধুরা, আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হল জৈন ধর্ম ও মহাবীর বর্ধমান।খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ভারতে ধর্মীয় আলোড়নের যুগ হিসেবে চিহ্নিত। বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুসারে এই যুগে ভারতে ৬৩টি প্রতিবাদী ধর্মের উত্থান হয়েছিল। এই ৬৩ ধর্মমতের মধ্যে জৈন ধর্ম ছিল উল্লেখযোগ্য। আজ আমরা এই অধ্যায়ে জৈন ধর্ম ও জৈন ধর্মের প্রবক্তা মহাবীর এর জীবন, সন্ন্যাস জীবন, তাঁর প্রবর্তিত নীতি, জৈন ধর্মের প্রসার, জৈন ধর্মে বিভাগ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন উত্তর আলোচনা করব। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। স্কুলের পরীক্ষা , যে কোন চাকরীর পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে প্রশ্ন এসেই থাকে। তাই আর দেরি না করে দেখে নাও আজকের আলোচনা……..
মহাবীর বর্ধমান
জন্ম
আনুমানিক ৫৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কুন্দপুর (বর্তমান মজ:ফরপুর জেলার ‘বসার’ গ্রাম) নামক স্থানে জ্ঞাতৃক নামক ক্ষত্রিয় রাজকূলে মহাবীরের জন্ম। বাল্য নাম ছিল বর্ধমান।
বংশ পরিচয়
তাঁর পিতার নাম সিদ্ধার্থ।
তাঁর মাতা ছিলেন লিচ্ছবি বংশীয়া রাজকন্যা ত্রিশলা।
তাঁর পত্নী ছিলেন যশোদা।
কন্যা ছিলেন প্রিয়দর্শনা।
সন্ন্যাস গ্রহণ ও সাধনা লাভ
৩০ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। দীর্ঘ 12 বছর কঠোর সাধনার পর ঋজুপালিকা নদী -র তীরে এক শাল গাছ এর নিচে তিনি কৈবল্য বা সিদ্ধিলাভ করে ‘জিন’ বা ‘জিতেন্দ্রিয়’ নামে বিখ্যাত হন।
জৈন ধর্মে ‘ত্রিরত্ন’ বলতে কী বোঝায়?
কর্মফলের হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য ‘ত্রিরত্ন’ অর্থাৎ সৎ জ্ঞান, সৎ বিশ্বাস এবং সৎ আচরণ এই তিনটি নীতি পালন করার উপর জৈন ধর্মে জোর দেওয়া হয়েছে।এই তিনটি নীতিকেই একত্রে ‘ত্রিরত্ন‘ বলা হয়।
পঞ্চমহাব্রত নীতি
জৈন ধর্মের ‘পঞ্চমহাব্রত‘ হল এই ধর্মের পাঁচটি মূলনীতি।এগুলি হল- অহিংসা, সত্যবাদিতা, অচৌর্য বা চুরি না করা অপরিগ্রহ অর্থাৎ পরদ্রব্য গ্রহণ না করা এবং ব্রহ্মচর্য পালন করা।
দ্বাদশ অঙ্গ
জৈন ধর্মের মূল সূত্রগুলি দীর্ঘদিন মৌখিকভাবেই প্রচলিত ছিল।এই ধর্ম সূত্রগুলিকে লিপিবদ্ধ করার জন্য আনুমানিক ৩০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে পাটালিপুত্রে জৈনদের এক ধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে জৈন ধর্ম শাস্ত্র কে ১২ টি ‘অঙ্গ’-এ সংকলিত করা হয়। এগুলোকেই বলে দ্বাদশ অঙ্গ।
জৈন আগম বা জৈন সিদ্ধান্ত
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে গুজরাটের বলভী তে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জৈন সংগীতিতে আবার নতুন ভাবে জৈন ধর্মগ্রন্থ সংকলন করা হয়। বর্তমানে ওই সংকলন ‘জৈন আগম’ বা ‘জৈন সিদ্ধান্ত’ নামে পরিচিত। এই ‘জৈন সিদ্ধান্ত’ অঙ্গ, উপাঙ্গ, মূল ও সূত্র নামে চারটি ভাগে বিভক্ত।
জৈন ধর্মের প্রসার
জৈন ধর্ম প্রথমে পূর্ব ভারত অর্থাৎ অঙ্গ, বিদেহ ও কোশল রাজ্য প্রচলিত হয়। পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যে ও জৈন ধর্ম প্রচলিত হয়।এছাড়া কলিঙ্গ মগধ মালব,গুজরাট, রাজস্থান প্রভৃতি স্থানেও জৈন ধর্ম প্রচলিত হয়।বহিরভারতে কখনো জৈন ধর্মের প্রসার হয়নি।
জৈন ধর্মের বিভাগ
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভদ্রবাহু ও স্থুলভদ্রের নেতৃত্বে জৈন ধর্ম দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি হল শ্বেতাম্বর অন্যটি হল দিগম্বর।
শ্বেতাম্বর
১. স্থূলভদ্রের নেতৃত্বাধীন জৈন সন্ন্যাসী।
২. পার্শ্বনাথকে কে অনুসরণ করতেন।
৩. শ্বেত বস্ত্র পরিধান করতেন।
৪. এরা হলেন উত্তর ভারতের জৈন সন্ন্যাসী ।
দিগম্বর
১. ভদ্রবাহুর নেতৃত্বাধীন জৈন সন্ন্যাসী।
২. মহাবীরের অনুশাসন গুলি কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন।
৩. বস্ত্র পরিধান করতেন না।
৪. এদের স্থান ছিল দাক্ষিণাত্যে।
জৈন ধর্ম ও মহাবীর বর্ধমান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর
১. তীর্থঙ্কর কাদের বলা হত?
উঃ জৈন ধর্মের প্রবক্তাদের তীর্থঙ্কর বলা হত।
২. প্রথম ও শেষ তীর্থঙ্কর কে ছিলেন?
উঃ ঋষভদেব এবং মহাবীর।
৩. জৈন ধর্মের কতজন প্রবর্তক ছিলেন?
উঃ ২৪ জন প্রবর্তক ছিলেন।
৪. ২৪তম তীর্থঙ্কর কে ছিলেন?
উঃ মহাবীর।
৫. মহাবীর এর বাল্য নাম কি ছিল?
উঃ বর্ধমান।
৬. তাঁর পিতার নাম কি?
উঃ সিদ্ধার্থ।
৭. কোন নদীর তীরে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন?
উঃ ঋজুপালিকা নদীর তীরে।
৮. জৈন কথাটির উদ্ভব কোথা থেকে?
উঃ জিন শব্দ থেকে জৈন কথাটি এসেছে।
৯. জিন শব্দের অর্থ কি?
উঃ বিজয়ী বা জিতেন্দ্রিয়।
১০. কৈবল্যের মাধ্যমে বর্ধমান কামাদিরিপু ও সুখ-দুঃখকে জয় করেছিলেন বলে তাকে কি বলা হয়?
উঃ মহাবীর।
১১. সিদ্ধি লাভের পর তিনি কোন কোন স্থানে ধর্ম প্রচার করেন ?
উঃ মগধ,অঙ্গ,কোশল, মিথিলা, নালন্দা,রাজগৃহ, বৈশালী ও উত্তর পূর্ব ভারতের নানা স্থানে।
১২. তিনি কত বছর ধরে ধর্ম প্রচার করেন?
উঃ ত্রিশ বছর ধরে।
১৩. কত খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যু হয়?
উঃ ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৭২ বছর বয়সে রাজগৃহের কাছে পাবা নগরীতে তার মৃত্যু হয়।
১৪. জৈনরা কিসে বিশ্বাসী নন?
উঃ জৈন রা বেদের অভ্রান্ততা যাগযজ্ঞের কার্যকারিতা বা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন।
১৫. জৈনরা কিসে বিশ্বাসী?
উঃ জৈন রায় হিন্দুদের মত কর্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী।
১৬. পার্শ্বনাথ কে ছিলেন?
উঃ ২৩ তম তীর্থঙ্কর।
১৭. জৈন ধর্মের প্রকৃত প্রবর্তক কে?
উঃ পার্শ্বনাথ।
১৮. পার্শ্বনাথ কবে আবির্ভূত হন?
উঃ মহাবীরের জন্মের আড়াইশত বছর পূর্বে।
১৯. পার্শ্বনাথ এর জন্ম কোথায় হয়?
উঃ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে কাশীর এক রাজবংশে।
২০. পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত ধর্মের মূলমন্ত্র কি ছিল?
উঃ অহিংসা, সত্য, অচৌর্য ও অপরিগ্রহ।
২১. এই চারটি আদর্শ কি নামে বিখ্যাত?
উঃ চতুর্যাম।
২২. জৈন ধর্ম মতের সমর্থক কারা ছিলেন?
উঃ মগধ রাজ বিম্বিসার , অজাতশত্রু ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
২৩. জৈনদের আদি শাস্ত্রগ্রন্থ কোনটি?
উঃ ভদ্রবাহু রচিত কল্পসূত্র।
২৪. জৈন সিদ্ধান্ত কে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয় কি কি?
উঃ অঙ্গ,উপাঙ্গ, মূল ও সূত্র।
২৫. জৈন ধর্ম গ্রন্থ গুলি কোন ভাষায় রচিত?
উঃ প্রাকৃত ভাষায়।
২৬. জৈন দার্শনিক কারা ছিলেন?
উঃ ভদ্রবাহু,হেমচন্দ্র,সিদ্ধসেন ও হরি ভদ্র।
২৭. দিগম্বর নামে কারা পরিচিত?
উঃ ভদ্রবাহুর নেতৃত্বাধীন জৈন সন্ন্যাসীগণ।
২৮. শ্বেতাম্বর নামে পরিচিত কারা?
উঃ স্থূলভদ্রের অনুগামী জৈন সন্ন্যাসীগণ।
২৯. বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ গুলিতে মহাবীর কে কি নামে অভিহিত করা হয়েছে?
উঃ ‘নিগন্থ জ্ঞাতপুত্ত’।
৩০. তিনি কোন বৃক্ষের নীচে ধ্যান করেছিলেন?
উঃ অশোক বৃক্ষ।
৩১. মহাবীরের প্রধান শিষ্য কে ছিলেন?
উঃ গৌতম স্বামী।
৩২. কল্পসূত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তু কি?
উঃ মহাবীর এর জীবনী।
৩৩. জৈনদের ধর্মীয় সাহিত্য কোন ভাষায় রচিত হয়েছিল?
উঃ অর্ধ-মাগধীতে।
৩৪. জৈন ধর্ম শাস্ত্র গুলির নাম কি?
উঃ পরিশিষ্ট পার্বণ, জৈন সিদ্ধান্ত, কল্পসূত্র, ভগবতী সূত্র ও চতুর্বেদ।
৩৫. মহাবীরের প্রথম শিষ্য কে ছিলেন?
উঃ জৈমেলী।
৩৬. মহাবীর কোন গাছের নিচে দিব্য জ্ঞান লাভ করেন?
উঃ শাল গাছ।
৩৭. দ্বাদশ অঙ্গ কোন ভাষায় রচিত?
উঃ প্রাকৃত ভাষা।
৩৮. কোন কোন ভারতীয় নৃপতিরা জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন?
উঃ কলিঙ্গরাজ খারবেল, কাঁথিওয়াড়ের রাজা মন্ডলীক, গুজরাট রাজ জয়সিংহ ও কুমার পাল। এছাড়া দাক্ষিণাত্যের চালুক্য রাষ্ট্রকূট ও গঙ্গ রাজাদের নাম উল্লেখযোগ্য।
৩৯. প্রথম জৈন সংগীতি কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
উঃ পাটালিপুত্রে।
৪০. প্রথম জৈন সংগীতির সভাপতি কে ছিলেন?
উঃ স্থুল্ভদ্র।
৪১. দ্বিতীয় জৈন সংগীত কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?
উঃ গুজরাটের বলভী তে।
৪২. দ্বিতীয় জৈন সংগীতির সভাপতি কে ছিলেন?
উঃ দেবার্ধি।
৪৩. কোন জৈন সংগীতিতে দ্বাদশ অঙ্গ সংকলিত হয়?
উঃ প্রথম জৈন সংগীতি।
৪৪. জৈন আগম বা জৈন সিদ্ধান্ত কোন জৈন সংগীতিতে সংকলিত হয়?
উঃ দ্বিতীয় জৈন সংগীতি তে ।
৪৫. মহাবীরের সন্ন্যাস গুরু কে ছিলেন?
উঃ গোশাল।
৪৬. জৈনদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম কি?
উঃ দ্বাদশ অঙ্গ।